Crocodile Farming in Bangladesh

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কুমির চাষ এবং সফলতার গল্প

ফার্মের শুরু থেকেই আমাদের সাথে গনমাধ্যমের খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। অনেক সাংবাদিকের সাথে পরিচয় হয়েছে, যে কারণে রেপ্টাইলস ফার্ম বা কুমির চাষ কিছুদিন পরপর পত্রিকা বা টিভিতে দেখা যেত। চেষ্টা করতাম নতুন কোন খবর দিতে। কুমীরের ডিম পারাটাও এক সময় পত্রিকার পাতায় খবর হিসাবে আসত। প্রচারের কারণে দর্শকের সংখ্যায় বাড়তে থাকে। কাছেই ঘাটাইল ক্যান্টনমেন্ট হওয়ায় ওখানকার সেনা কর্মকর্তারা প্রায় সময় সপরিবারে বেড়াতে আসতো।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে —বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি থেকে এখানে স্টাডি ভিজিটে আসতো। আমি এবং আমাদের কর্মকর্তা — কর্মচারীরা সবাই এটা উপভোগ করতাম। তবে আমরা কিছু নিয়ম কানুন সমস্ত ভিজিটরকেই বলে দিতাম — যেমন, শব্দ করা যাবে না, ফার্মের ভিতরে কিছু খাওয়া যাবে না, কুমির বা কোন পাখীকে বিরক্ত করা যাবে না, ব্যাপারগুলো খুবই ছোট- কিন্তু, আমাদের পরিবেশটা ছিল ভিন্ন।

৩রা জুনে রপ্তানির তারিখটা আমি আগে থেকে কোন সাংবাদিককেই জানাই নাই। প্রথমবার কুমির রপ্তানির জন্য আমরা detail plan তৈরি করি। ২ তারিখ সন্ধ্যায় লিপা, রীতা আর আমি ঢাকা থেকে ফার্মে যাই। আল-আমিন ড্রাইভার আমার সার্বক্ষণিক সহকারী। গাড়ির মধ্যেই আমার ল্যাপটপ, ফাইল, কাগজপত্র, সিল- মোটকথা পুরো অফিস। প্ল্যান ছিল — সকাল থেকে কুমির গুলোকে প্রসেস করবো। ফার্মে আমার যেই বেডরুম ছিল সেখানে A/C একদম ঠাণ্ডা করা থাকবে, কুমির গুলোকে প্রথমে এনে এখানে রাখা হবে। সমস্ত ফার্নিচার সরিয়ে পুরো ফ্লোর জুড়ে বরফ বিছিয়ে রাখা হবে। দুপুর বারোটা নাগাদ এয়ারকন্ডিসন্ড কভারড ভান আসবে, সেটায় করে কুমির গুলোকে ঢাকায় পাঠানো হবে।

ঢাকায় নিকুঞ্জতে এনেম এন্টারপ্রাইসের গোডাউনে বিকালের দিকে “ড্রাই আইস” আসবে। সেখানে চূড়ান্ত প্যাকিং হবে।

রীতার আব্বা মরহুম ডঃ আলম ছিলেন একজন নামকরা anesthesiologist আর রীতা ছিল zoology র ছাত্রী। রীতা একদিকে লিপার বন্ধু আরেকদিকে ছিল আমাদের বিয়ের ঘটক। আলম আঙ্কেল জানতেন আমার কুমির প্রজেক্টের কথা, উনাকে যখন বলা হলো — এই আমাদের পরিকল্পনা, তখন উনি বলে দিলেন norcuron ব্যাবহার করতে হবে আর ওষুধের পরিমাণ কি হবে।

বাংলাদেশে ফ্রিজার কভারড ভান পাওয়া বেশ ঝামেলা। প্রথমে খোজ করে পেলাম হরটেক্স ফাউন্ডেশনের সন্ধান। কিন্তু ওরা জানিয়ে দিলো ওরা শুধুমাত্র ফল-মুল, শাক-সব্জি পরিবহন করে, কুমির তারা করতে পারবেনা। শেষ পর্যন্ত ডেস্মন্ড আরেকটা ভানের সন্ধান পেল। কথা ছিল —- এই দ্বিতীয় ভ্যানটি দুপুর বারোটায় ভালুকা পৌঁছাবে।

৩রা জুনে ছিল আমাদের ৫ম বিয়ে বার্ষিকী। ওইদিন সকালে আমাদের প্রথম কাজ ছিল m-100 নাম্বারের কুমিরটাকে ধরা, যেটা নিয়ে আমাদের সমস্ত স্টাফদের মধ্যে ছিলো উত্তেজনা — কিভাবে সম্ভব হবে??

১৪ফুট লম্বা প্রায় ৭০০ কেজি ওজনের একটি কুমির
এই কুমিরটি ছিল ফার্মের সবচেয়ে বড় কুমির ১৪ফুট লম্বা প্রায় ৭০০ কেজি ওজন।

এটা ছিল ফার্মের সবচেয়ে বড় কুমির ১৪ফুট লম্বা প্রায় ৭০০ কেজি ওজন। আমাদের প্রত্যেকটা কুমীরের একটা নির্দিষ্ট নাম্বার ছিল ম-১০০ সেরকম একটি নাম্বার, এই কুমিরটার আরেকটা নাম ছিল- এটাকে আমরা “বস” বলে ডাকতাম। সেদিন আমার সব রকম বাইরের দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ করে বারোজন কর্মকর্তা- কর্মচারী নিয়ে কাজ শুরু করি। সংগে ছিল রীতা, লিপা আর আল-আমিন।

সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই L1 (প্রত্যেকটি পুকুরের আলাদা নাম্বার ছিল, L1 মানে লেগুণ ওয়ান) গিয়ে বসের অবস্থান দেখে খুশি হয়ে গেলাম। আমাদের অনেকরকম বিকল্প পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু বস এমন জায়গায় অবস্থান করছিলো, যাতে করে আমি দেওয়ালের বাইরে থেকে খুব সহজে বসের কাছে যেতে পারবে ইনজেকশন দেয়ার জন্য। মাত্র ১৫ মিনিট সময়ে আমাদের সবচেয়ে দুরূহ কাজটা কোনরকম ঝামেলা ছাড়াই করে ফেলি।

আমাদের কুমির প্রসেস করা যখন প্রায় শেষের পথে তখন ডেস্মন্ড ফোনে জানালো ভ্যানের এয়ারকন্ডিসন কাজ করছে না। তখন সময় দুপুর বারোটা। কোন বিকল্প পরিকল্পনা ছিলনা। উনাকে বললাম ভ্যানটা নিয়ে ভালুকা চলে আসতে, আর আমি লোক পাঠালাম ভালুকা থেকে বরফ আর লবণ নিয়ে আসতে। ভ্যান আসার আগের সময় টুকু কুমীরের উপর বরফ দিয়ে তার উপর লবণ ছিটিয়ে দিলাম।

দুপুর একটার দিকে আমাদের সবগুলো কুমির প্রসেস করা হয়ে গেলো, এরপর বাকি থাকলো ট্যাগ করা আর বারকোড লাগান। শেষ কুমিরটাকে ইনজেকশন দিতে গিয়ে আমাদের শেষ সিরিঞ্জটাও ভেঙ্গে গেল। তাছাড়া তখন একটা বড় রকমের দুর্ঘটনা থেকে আমি বেচে গিয়েছিলাম। কুমিরটা এমন জায়গায় ছিল, ইনজেকশন আমাকে দিতে হয়েছে সামনে থেকে কুমীরের হা করা মুখে।

ইনজেকশন দেওয়ার সাথে সাথে কুমির মুখ বন্ধ করে ঝাঁকি দেওয়ায় আমি প্রায় ছিটকে পরে গিয়েছিলাম। ততক্ষণে ইনজেকশনের কার্যকারিতা শুরু হয়ে যাওয়ায় কুমিরটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এরপর শুরু হলো বরফের উপর দাঁড়িয়ে, ঠাণ্ডা ঘরে ৬৭টা কুমিরকে মাইক্রোচিপ লাগানো, তারপর সেটা পলিথিন দিয়ে পেঁচিয়ে উপরে বারকোড লাগানো। ওজন আর মাপ নেওয়া হলো প্রতিটি কুমীরের। তারপর শুরু হলো ভ্যানের জন্য অপেক্ষা।

সেদিন সাংবাদিকদের আগে থেকে না জানালেও, বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা ডকুমেন্টারি তৈরির জন্য একটা মিডিয়া টিম ছিল ফার্মে। ওরা দুপুরের পর এসেছিল, তাদের বলে দিয়েছিলাম আপনারা জ্যান্ত কুমীরের ছবি তুলেন আর চেয়ারম্যান সাহেবের ইন্টারভিউ নেন। কিছুক্ষণ পর তারা আমার ইন্টারভিউ নিবে, আমার গায়ে তখন কাদা লেগেছিল। শুধু টিশার্ট পালটে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম। যেহেতু এটা বাংলাদেশ ব্যাংক তৈরি করছিল- তাই আমাকে বিশেষ করে EEF সম্বন্ধেই বলতে হলো।

ঈঈএফ ফান্ড না থাকলে বাংলাদেশে কুমীরের ফার্ম হতো কিনা আমার সন্দেহ আছে। ২০০২/২০০৩ সালে বাংলাদেশে যত রকমের ব্যাংকের ফান্ডিং প্যাকেজ ছিল আমি তার সব গুলোই ঘেটেছিলাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঈঈএফ ফান্ডের কোন কোন খাতে বিনিয়োগ করে তার একটা লিস্ট ছিল। ১৭ নাম্বার খাতটা ছিল ‘অন্যান্য’ – আমি এই খাতে আবেদন করেছিলাম। সেটাই ক্যামেরার সামনে বলে দিলাম।

ভ্যান তখনও পৌঁছায় নাই, কিন্তু হটাত আকাশ মেঘলা হতে শুরু করলো।

ভরাডোবা-ঘাটাইল রাস্তা থেকে ফার্মে ঢোকার জন্য আধা কিলোমিটার রাস্তা ছিল কাঁচা। বৃষ্টি হলে ওই রাস্তা দিয়ে ভ্যান ফার্মে ঢুকবে না। আবার উত্তেজনা বাড়তে লাগলো। এর মধ্যে উথুরা বাজার থেকে মিষ্টি এনে ফার্মের প্রথম রপ্তানি সবাই মিলে পালন করলাম। লিপা আমাকে মিষ্টি খাওয়ানর সময় মুখের সামনে ক্যামেরা ধরে আমাকে জিজ্ঞেস করলো —- আপনার অনুভতি কি- আমার উত্তর ছিল “প্রশান্তি”।

ঠিক বিকাল পাঁচটায় ডেস্মন্ড কুমির সহ ভ্যান নিয়ে রওনা দিয়ে দিলো। ভ্যানের মধ্যে কুমীরের সাথে অনেক বরফ দিয়ে দিলাম। ভ্যানের পিছনের গাড়িতে লিপা, রীতা আর আমি রওনা দিলাম। আমি রাস্তায় উঠে আমার পরিচিত সব সাংবাদিক কে SMS দিয়ে জানালাম ।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে কুমির চাষ ও সম্ভবনা
বাণিজ্যিকভিত্তিতে কুমির চাষ এবং সফলতার গল্প (পর্ব-৫)

আমরা পাকা রাস্তায় উঠার পর পর শুরু হলো বৃষ্টি। বিকালটা খুব সুন্দর ছিল, বৃষ্টি পড়ছিল, শেষ বিকালের আলো ছিল—– আর উথুরা থেকে ভরাডোবা যাওয়ার রাস্তাটা এমনিতেই খুব সুন্দর, আকাবাকা রাস্তা। কখনো রাস্তার পাশে বিশাল পুকুর, আবার কখনো জঙ্গল।

রাত আটটার কিছু আগে abc radio থেকে ফোন করে জানালা রাত আটটার খবরে তারা আমাদের কুমির রপ্তানির খবর প্রচার করবে আর তখন লাইভে আমাকে ফোন ইনে নিতে চায়। আমাদের আডডা থামিয়ে ওয়েট করছিলাম ফোনের জন্য, এদিকে গাড়িতে তখন abc radio টিউন করা। কি প্রশ্ন করেছিলো, আমি কি বলেছিলাম মনে নাই, তবে সেটাই ছিল বাংলাদেশ থেকে কুমির রপ্তানির প্রথম সংবাদ প্রচার।

আমরা যখন প্ল্যান তৈরি করি তখন হাতে ৬ ঘন্টা সময় বাড়তি রেখেছিলাম। রাত নয়টায় ভ্যান গিয়ে পৌছাল নিকুঞ্জ, যেখান ফাইনাল প্যাকিং হবে। বিশেষ বাক্সগুলো ছিল কাঠের, তার ভিতরে ছিল কর্কশিটের একটা স্তর, তার ভিতরে পলিথিন। প্যাকিং লিস্টের সাথে মিল রেখে পাঁচটা বাক্সে ৬৭টি কুমির প্যাক করতে করতে রাত তিনটা বেজে গেলো। রাতে বাক্স সহ ট্রাক এয়ারপোর্টের কার্গো টার্মিনালের গেটে রেখে দেওয়া হলো।

বাংলাদেশ থেকে কুমির জার্মানির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় ৪ঠা জুন ২০১০ সালে। কিন্তু এর পিছনে ছিল অনেকের সম্মিলিত শ্রম আর সহযোগিতা। রম্য ভাইয়ের আইডিয়া, তারপর আনিস ভাইয়ের দিক নির্দেশনা, এরপর এলো রেজা খান স্যারের উপদেশ । বিজনেস প্ল্যান তৈরি হওয়ার পর দেখা গেলো USAID এর প্রতিযোগিতা, এই প্রতিযোগিতার পর দেশের আটটা প্রথম সারির পত্রিকায় পুরো পাতা জুড়ে স্পেশাল সাপ্লিমেনট বের হয়েছিলো । এই পরিচিতির সূত্র ধরেই আমি SEDF এর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলি। SEDF তখন একটি নতুন প্রতিষ্ঠান, World Bank একটা বিভাগ বলা চলে, মাত্র কিছুদিন হলো কাজ শুরু করেছে। SEDF ওয়েবসাইটে দেখলাম SEDF রিস্কি অথচ ইনভেটিভ ভেঞ্চারকে প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।

আগের অভিজ্ঞতা থেকে জানা ছিল, পরিচিতি না থাকলে ব্যাংক আমার কোন কথাই শুনবে না। এই একটা জায়গায় বাংলাদেশে বেশীর ভাগ উদ্যোক্তা আটকে যায়। রাজিভ গোপালের সাথে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা মিটিং করেছি। SEDF এর কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থায়নের জন্য এগিয়ে এসেছিল। ২০০৩ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর রেপ্টাইলস ফার্ম লিমিটেড রেজিস্টার করার সাত বছর পর — ৪ঠা জুন ২০১০ সালে প্রথম কুমির রপ্তানি হয়।

একটা ছবি — যেখানে আমি আর লিপা কুমীরের উপর বসে আছি, সেই ২০১০ সাল থেকেই ফেসবুকে আছে — এখানে তিনটা কুকুর আছে। কুকুর গুলোর খুব সুন্দর নাম ছিল- বুশ, লাদেন আর কন্ডি। আমার আরেকটা পোষা কুকুর ছিল যেটার নাম ছিল সিন্ডি। এই চারটা কুকুরের কোন বিশেষত্ব ছিলোনা, তবে এরা অসম্ভব বিশ্বস্ত ছিল। আমি ফার্মে থাকলে দরজা খলা রেখেই ঘুমাতাম। দরজার দুইপাশে থাকতো বুশ আর লাদেন। বাইরের কারো জন্য ফার্মে ঢোকা প্রায় অসম্ভব ছিল এদের জন্য। আরেকটা মজার ব্যাপার ছিলো — এগুলো লুঙ্গি পরা কাউকে দেখলেই লুঙ্গি নিয়ে টানাটানি করতো। এখানে বলে রাখা দরকার, ফার্মের পক্ষ থেকে প্রত্যেক স্টাফকে জুতা থেকে শুরু করে প্যান্ট, শার্ট, এমনকি শীতকালের জন্য গরম কাপড়ও দেওয়া হয়েছিলো।

চার তারিখ সকালে আর আমাদের করার তেমন কিছু ছিল না। আমরা পাঁচটা কাঠের বাক্স আর কাগজপত্র এয়ারলাইনের কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে দিলাম সকাল দশটায়, কিন্তু তার আগেই ATN New এর ক্যামেরাম্যান হাজির। ইচ্ছে ছিল বন্যপ্রাণীর বাণিজ্যিক ফার্ম করে, সমস্ত আন্তর্জাতিক আইন মেনেই বাংলাদেশে বিজনেস করা সম্ভব- এটার প্রমাণ করা।

yes, we made it 🙂

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।