Crocodile Farming in Bangladesh

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কুমির চাষ এবং সফলতার গল্প

প্রথম দিন মাঠে গিয়ে কিছু বিরল অভিজ্ঞতা হলো। কোথা থেকে শুরু করবো। একটা জায়গা ঠিক করলাম,যেখানে টিউব ওয়েল বসানোর কাজ শুরু হলো। আরেক দিকে জঙ্গল পরিষ্কারের কাজ। দড়ি টেনে, খুঁটি গেড়ে চেষ্টা করলাম কাগজের ড্রয়িং টাকে মাটিতে বসানোর।

তারপর মনে হলো দুপুরে খাব কোথায়? আমাদের জমির পাশেই ছিল নাতুদের বাড়ি, সেও এখানে কাজ করছিল, সে আমাদেরকে তার বাসায় খেতে বললো। খুব মজা করে দেশি মুরগির ঝোল (অনেক ঝাল), ডাল আর ভাত। গাছের নিচে, মাদুর পেতে সবাই মিলে খেলাম। নাতুর বউ রান্না করেছিলো, আমাদের কাছ থেকে শুধু মুরগিটার দাম নিয়েছিল। কয়েক বছর আগে নাতু মারা গেছে, বেশ কিছুদিন অসুখে ভুগে। আমাদের কাছে নাতুকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল সে নাকি আগে গাছ চুরি করতো, ডাকাত ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি তাকে সবসময় বিশ্বস্ত কর্মচারী হিসাবেই পেয়েছি। অসম্ভব সাহসী।

আমরা উথুরা ইউনিয়নের হাতিবের মৌজার ৫৬১ নং দাগের ৬ একর জমি প্রথমে কিনেছিলাম আর বাকি ৭.৪০ একর জমি বায়না করেছিলাম। একই দাগে আরও ০.২৮ একর বন বিভাগের জমি ছিল যা নাকি করা demarcated ছিল না । আমাদের কাজ শুরু আগেই জমি বিক্রেতা বন বিভাগ কে চিঠি দিয়েছিলো, বন বিভাগের জমি demarcate করার জন্য। বন বিভাগের এই জমি ফেরত দিতে আমাকে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে।

অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়টা খুব কম ছিল ফার্ম তৈরি করার জন্য, অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী বলছিল কুমির আমদানি পেছানোর জন্য। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম কুমির ডিসেম্বর মাসেই আনা হবে, সেই হিসাবে রাত দিন কাজ শুরু হলো। ১৪ টা বিভিন্ন মাপের পুকুর হবে। যার মধ্যে কোনটাতে দুইটা থেকে শুরু করে কোনটাতে ৭টা কুমির থাকবে। একটা টিনের ঘর তোলা হলো, যেখানে সিমেন্ট আর মাটি কাটার অন্যান্য যন্ত্রপাতি থাকত। এখানে একটা টেবিল আর একটা চৌকি ছিল। এটাই রেপ্টাইলস ফার্মের প্রথম অফিস। এটার কোন দরজা ছিল না। আমিও এখানে রাত কাটিয়েছি ।

একদিন রাতে ঘুমের মধ্যে আওয়াজ শুনে লেপ থেকে মাথা বেড় করে দেখি শিয়াল। প্রচণ্ড শীত ছিল তখন। সকালে পাওয়া যেত গরম ভাপা পিঠা আর খেজুরের রস। মুন্সি নামের এক বুড়োলোক ছিল, যে ফার্মের এক কোনায় আগে থেকে রাতে থাকতো। সেই আমাদের দুপুরের খাবার রান্না করতো, যা আমরা গাছের নিচে বসে খেতাম। আমরা এটাকে ক্যাফে মুন্সি বলতাম। পরে এক সময় ওর ঘরটা সরিয়ে ফেলতে হয়েছিল, কিন্তু অক্টোবর থেকে প্রথম ছয় মাস মুন্সি আমাদের রান্না করতো। সেটা আমারা আমাদের মালয়েসিয়ান বন্ধুদেরকেও খাইয়েছি।

আমরা অক্টোবর মাস থেকে কাজ শুরু করলেও ফার্মে আমাদের থাকার কোন ব্যাবস্থা ছিল না। রাত কাটিয়েছি ইউনিয়ন পরিষদের অফিসে, এর পর লিটন চৌধুরীর বাসায় থাকতাম। ঐ এলাকায় তখন অনেক ডাব পাওয়া যেত আর খুব ভাল পেঁপে পাওয়া যেত। এলাকায় কুমিরের ফার্ম হবে- এটা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। প্রথম ধাপে ১৪ টি পুকুর করার পরিকল্পনা থাকলেও, ডিসেম্বর এর মধ্যে সব গুলোর কাজ শেষ হলো না। প্ল্যান করলাম ২৫ টা কুমির একটা পুকুরেই ছেড়ে দিবো। পকুরের গভীরতা ছিল ৫ ফুট আর প্রতিটা পুকুরের সাথেই ছিল খোলা জায়গা, যাতে কুমির রোদে বা ছায়াতে থাকতে পারে।

২৩শে ডিসেম্বর ২০০৩ সালের ফজরের আজানের সময় আমি ট্রাক নিয়ে ফার্মে ঢুকি । পাঁচটি ট্রাকে, ৪৫ টি কাঠের বাক্সে ৭.৫ থেকে ১২.৫ ফুট লম্বা ৭৫ টি কুমির দিয়ে যাত্রা শুরু হলো রেপ্টাইলস ফার্মের । প্রতিটি বাক্সে কুমিরের মাপ বলা ছিল, আর আমরা আগেই প্লান করেছিলাম কোন কুমির কোন পুকুরে ছাড়া হবে। সেই হিসাবে দুপুর ১১টা থেকে শুরু হলো কুমির ছাড়া। প্রক্রিয়াটা খুব জটিল কিছু না, তবে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। আমরা একজন প্রোফেসনাল ভিডিওগ্রাফার নিয়োগ করেছিলাম, সব কিছু ভিডিও করার জন্য।

প্রথম কুমির ছাড়ার সময়, যেই কুমির লাফ দিয়ে পানির দিকে গেছে, উনি ক্যামেরা ফেলে দৌড়। টানা ছয়ঘণ্টা ২৫ জনের পরিশ্রমে ৭৪ টা কুমির ছাড়া হলো। একটা কুমির রাস্তায় মারা গেছে ।

কুমির ফার্মে পৌঁছানোর পর আশেপাশের গ্রামে খবর চলে গেলো, এখানে কুমির আছে। অনেক মানুষ এসে ভিড় করলও কুমির দেখার জন্য। আমরা ২০ টাকা করে টিকেটের বিনিময়ে প্রথম দিকে গ্রামের মানুষদের কুমির দেখাতাম। একসাথে ২০ জনকে ঢুকিয়ে, একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে কুমির দেখাতাম। এটা আমরা মাসখানেক চালু রেখেছিলাম। তারপর দর্শনার্থীদের জন্য প্রবেশ নিষেধ করে দিয়েছিলাম।

একটা টিন শেড অফিস বানান হলো। প্রায় হাজার খানেক গাছ লাগান হলো। আমি তখন সপ্তাহে দুই তিনবার যাওয়া আসা করি। একবার ভালুকা গেলে দুই একদিন থেকে আসতাম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছিলো প্রতি মাসেই একটা দুইটা করে কুমির মারা যাচ্ছিল। আমরা ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকে ভেটারনারি ডাক্তার নিয়ে গেলাম। প্রথম দিকের আসল সমস্যা ছিল কুমির প্রায় মারামারি করতো। রাত বিরাতে আমাদের স্টাফরা বাঁশ নিয়ে দৌড়াতো কুমীরের মারামারি থামানর জন্য। ডাক্তার কুমীরের জন্য antibiotic দিয়েছিল, সুতরাং আমাদের তখন দিশেহারা অবস্থা। তিন চারটা কুমীরের তিন বেলা ইঞ্জেকশান দেওয়া রীতিমত দুরূহ কাজ ছিল।

একবার দুইটা কুমির মারামারি করার ফলে, একটার ঘাড়ে প্রায় ৬ ইঞ্চি লম্বা হয়ে কেটে গিয়েছিল, লোকাল এক ডাক্তারকে খবর দেওয়া হলো সেলাই করার জিনিশপত্র নিয়ে ফার্মে আসতে। ডাক্তার মনে করেছে, ফার্মের কোন কর্মচারী হয়তো আহত হয়েছে। ফার্মে আসার পর উনাকে যখন বলা হলো কুমীরের ঘাড়ে সেলাই করতে হবে, ডাক্তার তখন প্রায় অজ্ঞান হবার জোগাড়।

২০০৫ সালের মে মাসে প্রচণ্ড ঝড়ে ফার্মের দেওয়াল অনেক খানি পরে গিয়েছিল। আমি তখন ঢাকায়, ঝড় শুরু হয়েছিল বিকালে। আমাকে শীতল ফোন করে বলল দেওয়াল পরে যাওয়ায় কুমির সব উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল। প্রায় ২০০ ফুট টিনের বেড়া উড়ে গিয়েছিল। সেই রাতেই গ্রামের লোকজন টিনগুলো নিয়ে এসেছিল। রাতেই মেরামতের কাজ শুরু হলো। কিন্তু সকালে কুমির গুনতে গিয়ে- দুইটা কুমির কম পড়ল।

Freeing a crocodile baby in pond
২৩শে ডিসেম্বর ২০০৪ সালে প্রথম কুমির অবমুক্ত করার সময় তোলা।

দুইটা কুমির কম পেলাম, প্রায় আমাদের ঘুম হারাম। চারিদিকে খোজা শুরু হলো, ঘণ্টাখানেক পর একটা পাওয়া গেলো পূর্ব দিকের ধান খেতে। মাঠের শ্রমিকরা মাত্র ধান কাটতে গেছে, ধান ক্ষেতে দ্যাখে কুমির। কোন রকম দুর্ঘটনা ছাড়াই আমরা সেটাকে উদ্ধার করি — কিন্তু তারপরও একটা কুমির কম। দুপুর নাগাদ ফার্ম থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে পশ্চিম দিকে পাওয়া গেলো আরেকটা কুমীরের। অল্পের জন্য সেখানে কোন দুর্ঘটনা ঘটে নাই, কারণ পাশেই বাচ্চারা খেলছিল।

২০০৫ সালটা আমাদের জন্য কঠিন পরীক্ষার বছর ছিল। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের EEF Fund এর অনুমোদন হলো। ভাবলাম তিন সপ্তাহের মধ্যেই টাকা ছার হয়ে যাবে, সেটা হতে সময় নিলো ছয় মাস। এদিকে প্রায় প্রতি মাসেই কুমির মারা যাচ্ছে। ২০০৫ সালে কোন কুমির ডিম পারে নাই। আমরা যোগাযোগ করলাম জিওফ ম্যাকলেরের সাথে, যে ৩৫ বছর কুমীরের ফার্মে কাজ করে বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন।

২০০৬ সালের ৩রা অগাস্ট সকালে ফোন করে বললো – একটা কুমির ডিম পেড়েছে। ডঃ রশিদ, লিপা আর আমি ফার্মের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ফার্মে পৌঁছানোর পর সদলবলে A2 পুকুরেরর কাছে গিয়ে দেখি — কুমির তার ডিম পাহারা দিচ্ছে। ডঃ রশিদের নেতৃত্বে ডিম মার্ক করে তোলা হলো, মোট ৩৯ টা ডিম হয়েছিল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।