Crocodile Farming in Bangladesh

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কুমির চাষ এবং সফলতার গল্প

২০০৯ সালে হাইডেলবার্গ ইউনিভারসিটি থেকে বিভিন্ন মাপের কুমির চেয়ে একটা ইমেইল পাঠাল। দেখলাম কয়েকটা ছাড়া সবগুলাই আমরা রপ্তানি করতে পারব। packaging এর ক্ষেত্রে তাদের বেশ কিছু শর্ত ছিল। তাদের বলা ছিল কুমির গুলো আস্ত হিমায়িত অবস্থায় জার্মানি পাঠাতে হবে। কুমীরের চেয়ে packaging বেশী জটিল হয়ে গেল। তাদের শর্ত ছিল কুমির কে মারার আগে শুকরের মাংস খাওয়াতে হবে। মারার জন্য একটা বিশেষ ইনজেকশন ব্যাবহার করতে হবে, আর ড্রাই আইস দিয়ে কাঠের বাক্সে করে পাঠাতে হবে। তাও আবার ফার্মে কুমির মারার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তা জার্মানি পৌঁছাতে হবে।

কুমির চাষ শুরুর দিকে কয়েকটা বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে ছিল — মূলধন জোগাড় করা, প্রয়োজনীয় জমি জোগাড় করা এবং সরকারের কাছে অনুমতি আদায় করা। SEDF আমাকে মূলধন জোগাড় করা আর অনুমতি লাভে অনেক সাহায্য করেছে।

আমি তখন অনেকগুলো সফল ভিন্নধর্মী উদ্যোগের কেস স্টাডি পড়েছি।

গ্রামীণ ফোনের স্বপ্নদ্রষ্টা ইকবাল কাদিরের কেস স্টাডি আমাকে ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত করে। ‘৯০ এর দশকের প্রথম দিকে একদিন অফিসের computer network নষ্ট হয়ে গেলে সব কাজকর্ম থেমে যায়। অথচ তার কিছুদিন আগেও ফ্লপি ডিস্ক দিয়েই কাজ চলত। ইকবাল কাদিরের মাথায় ঢুকে যোগাযোগ ব্যাবস্থা মানুষের জীবন পাল্টে দিতে পারে। সেখান থেকেই শুরু আজকের গ্রামীণ ফোন। উনার প্রতিটি প্রতিবন্ধকতা কে জয় করার গল্প আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে।

আরেকটা কেস স্টাডি আমাকে ভীষণ অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে, সেটা হলো সাবির ভাটিয়া- হটমেইল এর জনক। চাকরি ছেড়ে ফ্রি ইমেইলের বিজনেস মডেল কোন ব্যাংক অর্থায়ন করতে চায় নাই। এমন কথাও বলেছিল আমরা চ্যারিটি না, উই মিন বিজনেস । ২০ টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান অপারগতা প্রকাশ করার পর ২১ নম্বর ব্যাংক তাদের ৩ লক্ষ ডলার দিয়েছিল- যা দিয়ে Hotmail এর যাত্রা শুরু। এর কয়েকবছর পর Hotmail এর সিংহ ভাগ শেয়ার Microsoft এর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল।

আমদের একটা ব্যাংকের সাথে প্রথম মিটিং এ, আমাদের চেয়ারম্যান বলে বসেছিলেন – you can not finance a crocodile farm with a chicken heart.

২০০৪ সালে কুমির আমদানির জন্য L/C খুলতে ব্যাংকে গেলে মুন্না (Kazi Kmk) ভাই ছিল তখন foreign trade ডেস্কে । কতখানি মার্জিন লাগবে এটা নিয়ে কথা হচ্ছিলো, উনি বললেন অন্যান্য মেশিন পত্রের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ব্যাংক ওগুলো বিক্রি করে টাকা আদায় করতে পারে, কুমীরের ক্ষেত্রে কি হবে?

শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী মুন্না ভাই আমাদের L/C ফর্ম ফিলাপ করে দিয়েছে। আমরা শেষ পর্যন্ত ১০০% মার্জিন দিয়েই কুমির আমদানি করেছিলাম। জীবন্ত কুমির আমদানি করতে হলে, সাধারন আমদানির জন্য যা যা লাগে, তার সাথে আরও কয়েকটি কাগজ বেশী লাগে। দুই দেশের বনবিভাগের অনুমতি, আরে বিমানের বিশেষ ব্যাবস্থা।

২০০৯ সালের জুলাই মাসে খোঁজ শুরু করলাম প্যাকিং কিভাবে হবে। আমি তখন “ড্রাই আইস” কি সেটাই জানতাম না। আমাদের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের বড় ভাই নরবারট মেন্ডিস ভাই এনেম এন্টারপ্রাইসের কর্ণধার — এগিয়ে এলেন। উনি বলে দিলেন, কোথায় “ড্রাই আইস” বানান হয়। দেখা গেলো সেখানে (Bangladesh Oxygen) আরেক বড় ভাই ইফতেখার Iftekhar Karim) ভাই আছেন। নরবারট ভাইয়ের লোকজন দফায় দফায় ফার্মে গিয়ে, কুমির দেখে মাপজোখ করে ঠিক করল বাক্সের মাপ কি হবে। পাঁচটা বিভিন্ন মাপের কাঠের বাক্সে ৬৭ টা কুমির পাঠানো হয়েছিল।

Freezing-crocodile-with-dry-ice-to-export
রপ্তানি করার জন্য কুমিরকে ড্রাই আইসের মাধ্যমে সংরক্ষন

প্যাকেজিং এর দুরূহ কাজটা তদারকি করেছিলো ডেসমণ্ড ডায়াস । আমাদের রপ্তানি করার জন্য দরকার ছিল ১২০০ কেজি “ড্রাই আইস”, সেখানে Bangladesh Oxygen এর এক শিফটের প্রডাকশন ক্ষমতা ছিল এর অনেক কম। বাংলাদেশ থেকে সরাসরি হাইডেলবার্গে কোন প্লেন যেত না। মোটামুটি যখন প্রায় সবকিছু ঠিক হলো, তখন ( ২০১০ সালের জানুয়ারী মাসে ) ইউরোপের আকাশে আগ্নেয়গিরির ছাইয়ের কারণে সমস্ত প্লেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেল।

৬৭টা কুমীরের মধ্যে ৬টি কুমির আমরা মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করে দিয়েছিলাম, যেহেতু ওই মাপের কুমির আমাদের ছিলোনা। সুতরাং আমাদের রপ্তানির সাথে আরেকটা আমদানি জড়িত ছিল। বন্য প্রাণী আমদানি রপ্তানির ক্ষেত্রে আমদানিকারক দেশের বন বিভাগ থেকে CITES Import Permit ইস্যু করার পর রপ্তানিকারক দেশের বন বিভাগ CITES Export Permit ইস্যু করে। আমরা বন বিভাগের প্যাচে পরে গেলাম, যেহেতু পুরো জিনিসটা বাংলাদেশের জন্য নতুন —- কোন কর্মকর্তা কোন কিছু বলে না।

হতাশ হয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলাম, এই দেশে নতুন কিছু সম্ভব না। নাদিরা কিরণ (Nadira Kiron) যেহেতু আগে থেকেই এই প্রোজেক্ট নিয়ে নিউজ করেছে, তার চোখে পড়ল আর সে আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলো ঘটনা কি?? —বললাম আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কুমির রপ্তানি হচ্ছে না। সে তখন সচিবালয়ে যাচ্ছিল এবং এই ব্যাপারে মন্ত্রী হাসান মাহমুদকে ক্যামেরার সামনে প্রশ্ন করে বসল। মন্ত্রীর সাথে সেখানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন প্রধান বন কর্মকর্তা আর বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব মিহির কান্তি মজুমদার।মিডিয়ার এই একটি প্রশ্ন বন বিভাগের গতি নিয়ে আসলো। আমরা পারমিট দুইটাই পেয়ে গেলাম।

হাইডেলবার্গ থেকে একটা নিদৃস্ট কোম্পানির নাম বলা হলো freight forwarder হিসাবে – Kuehne + Nagel Ltd. কাজ করবে, দেখা গেল ওখানে আমাদের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের আরেক বড় ভাই- রাফি ওমার ভাই আছেন প্রধান কর্মকর্তা হিসাবে। Airline হিসাবে ঠিক হলো — Thai Airlinesএর প্লেন এ কুমির যাবে , ওখানে আমাদের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছোট ভাই মোরশেদ তখন country head ছিল। প্লেনের ক্ষেত্রেও বিশেষ অনুমতি নিতে হয়েছিল- কারণ একটা ফ্লাইটের জন্য ১২০০ কেজি “ড্রাই আইস” অনেক বেশী। মে মাসের শেষ সপ্তাহে মালয়েশিয়া থেকে ৬টা কুমির চলে আসলো, তখন আমার ঠিক করলাম ৩রা জুন ফার্ম থেকে কুমির রপ্তানি করবো, যা ৪ঠা জুন সকালের প্লেন ঢাকা ছেড়ে যাবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।