২০০২ সালের জুলাই মাসে চাকরী ছেড়ে আমার গুরুর সাথে দেখা করতে গেলাম। আমার গুরু রম্য ভাই জিজ্ঞেস করল কি করবি? বললাম বন্যপ্রাণী নিয়ে কিছু করবো। ধানমণ্ডি আট নাম্বার ব্রিজের দক্ষিণ দিকে দাঁড়িয়ে দুইজনে সিগেরেট খাচ্ছিলাম। গুরু বললো কুমিরের ফার্ম কর। কথাটা পছন্দ হলো। এখনকার সাম্পান রেস্টুরেন্ট এর পাশে তখন একটা সাইবার ক্যাফে ছিল, ওখানে বসে ঘাটাঘাটি শুরু করলাম। সেই শুরু বাংলাদেশের প্রথম কুমিরের ফার্মের।
আমি কখনো বায়োলজি পড়াশুনা করিনি। কিন্তু সুন্দরবনে গাইড হিসাবে কাজ করার সুবাদে অনেক প্রাণী বিজ্ঞানীকেই চিনতাম। কুমিরের ফার্মের চিন্তা মাথায় ঢোকার পর প্রথমেই গেলাম আনিস ভাইয়ের কাছে। আনিস ভাই আমাকে লাঞ্চ করতে নিয়ে গেলেন আর প্রাথমিক ধারনা দিলেন। ডঃ রেজা খান সারের কথা বললেন, রমুলাস হুইটেকার এর কথা বললেন, আর বললেন কোথায় নিয়ম কানুন গুলো জানা যাবে।
আনিস ভাইয়ের সাথে কথা বলার পর আমার উৎসাহ আরো বেড়ে গেলো। যোগাযোগ করলাম রেজা খান স্যার এর সাথে। রেজা খান স্যার কে আমি ই-মেইল এ নানা রকম প্রশ্ন করি, উনি উত্তর দিতেন। ইন্টারনেট এ ঘাটাঘাটি করে CSG (Crocodile Specialist Group) এর কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করলাম।এই যোগাযোগের উপর ভিত্তি করেই ২০০২ সালের নভেম্বর নাগাদ একটা business plan দাঁড় করিয়ে ফেললাম। হিসাব করে দেখলাম আমার প্রয়োজন এক মিলিয়ন ডলার আর ১৪/১৫ একর জমি। রেজা খান স্যার একটা স্কেচ পাঠালেন, কুমীরের বাণিজ্যিক ফার্মে কি কি থাকতে হবে তার লিস্ট দিয়ে। ঐ সময়ে USAID এর একটা প্রোজেক্ট agro business plan competition আয়োজন করে। ওখানে বলা ছিল প্রথম দশজনকে পরকল্পনা বাস্তবায়নে USAID সহায়তা করবে।
কুমিরের বাণিজ্যিক ফার্মের পরিকল্পনা ওখানে ২৫০ প্রস্তাবের মধ্যে চতুর্থ হয়েছিল। ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে অ্যাওয়ার্ড সেরেমনির সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর USAID এর একজন পরিচালকের সাথে আমার পরিচয় হয়। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি রমুলাসকে চিনি নাকি। বললাম, আমি জানতাম এখানে কুমীরের ফার্ম করতে হলে আমাকে রমুলাস এর পরামর্শ লাগবেই। রমুলাস ১৯৮২ সালে কুমীরের ফার্মের উপর একটা feasibility study তৈরি করেছিলেন। উনি ৭০ দশকের প্রথম দিকে ম্যাদ্রাস ক্রকোডাইল ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখন জানতে পারলাম খান জাহান আলির মাজারের কুমীর পরিচর্যার ব্যাপারে সহায়তা করতে রমুলাস পরের মাসে বাংলাদেশে আসবেন। USAID আমাকে ব্যবস্থা করে দিল আমি যাতে রমুলাসের সাথে দেখা করতে পারি আর উনার সাথে বাগেরহাট যেতে পারি।
এভাবেই দেখা হলো লিভিং লিজেন্ড রমুলাস হুইটেকারের সাথে। উনাকে আমার business plan দেখালাম, দেখে বললেন সব ঠিক আছে – তোমার শুধু এখন কুমীর দরকার — ফার্ম শুরু করার জন্য।
একটা কাল্পনিক জমির দাম ধরে, জমি দেখা শুরু করলাম। প্রথম দিনেই মাওনার কাছা কাছি তিনটা জায়গা দেখলাম।
পান্থপথের হাবিব ভাই নিয়ে গিয়েছিলেন জমি দেখতে। এক এক করে আট নম্বর জমি দেখলাম ৫ই সেপ্টেম্বর ২০০৩ সালে, যেখানে বাংলাদেশের প্রথম কুমীরের ফার্মটা হয়েছে। ১৩ একর উঁচু নিচু জমি, কিন্তু মুল রাস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন। ঢাকা ময়মনসিংহ মুল সড়ক থেকে ১১ কিলোমিটার ভিতরে, উথুরা ইউনিয়নের হাতিবের গ্রাম। জায়গাটা পছন্দ হোল, উথুরা বাজারের দিলিপ বাবুর দোকানে বসে চা খেলাম আর জমির মালিকের সাথে কথা বললাম। তিন ভাই জমির মালিক। তখনও কোম্পানি registration হয় নাই। শুরু হোল জমি কেনার প্রক্রিয়া আর company registration প্রক্রিয়া।
১৮ই সেপ্টেম্বর ২০০৩ রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড রেজিস্ট্রেশান হলো RJSCতে। মেসবাহুল হক চেয়ারম্যান আর আমি বাবস্থাপনা পরিচালক।
এরই মধ্যে মালয়শিয়া থেকে প্রাথমিক ভাবে ৭৫ টি কুমির আমদানির জন্য MOU সাইন করে ফেলাম। জমি রেজিস্ট্রেশান এর প্রক্রিয়া দেখাশোনা করেছে মফিজ, এই ব্যাপারে আমার কোন রকমের ধারনাই ছিলনা। ১১ মাস লেগেছিল জমি রেজিস্ট্রেশান করে জমির দখল পেতে। এদিকে আরেকটা বড়ও সমস্যা দেখা দিল কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করতে গিয়ে। আমি নিজেও জানতাম না কুমিরের ফার্মে কিভাবে কাজ হয়। সাধারণ ধারনা থেকে বুঝতে পারি এখানে কুমীরকে খাওয়া দিতে হবে, পরিচর্যা করতে হবে এবং কুমীরের প্রজনন ঘটাতে হবে। শীতল কুমারকে পাওয়া গেলো যে নাকি আগে চিড়িয়াখানায় curator হিসাবে কাজ করেছে আর জাহিদ বন্য প্রাণী নিয়ে কাজ না করলে – তার আগ্রহ আছে এই কাজ করার জন্য। এদের দুই জনকে ফেব্রুয়ারী ২০০৪ সালে নিয়োগ দেয়া হল, আরে পাঠানো হোল মাদ্রাস ক্রকোডাইল ব্যাংকে – orientation এর জন্য।
২০০৩ সালের অক্টোবর মাসে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব এর কাছে অ্যাপ্লিকেশান করলাম কুমিরের বাণিজ্যিক খামার করার জন্য। কারিগরি সহায়তার জন্য SEDF এর সাথে চুক্তি করলাম ২০০৩ সালের শেষ দিকে। এর মধ্যে বাংলাদেশে প্রকল্প অর্থায়নের সমস্ত প্রস্তাব ও সম্ভবনা ঘেঁটে দেখলাম একমাত্র বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক এর EEF ভরসা।
SEDF আমাদের জন্য ব্যাংকে জমা দেওয়ার উপযোগী business plan তৈরি করে দিল। মোনা মেহতা এই জটিল কাজটি করেছিলেন। তাছাড়া sedf এর রাজিভ গোপাল মন্ত্রণালয় আর বাংলাদেশ ব্যাংকে কুমীর ফার্মের জন্য অনেক সময় দিয়েছেন, যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছেন এই প্রকল্পটি সম্ভব।
২০০৪ সালের মে মাসে আমরা মন্ত্রণালয় থেকে ফার্ম করার অনুমতি পাই। তখন জনাব মিহির কান্তি মজুমদার ছিলেন মন্ত্রণালয়ের জয়েন্ট সেক্রেটারি, যিনি আবার পরে ২০১০ সালে প্রথম রপ্তানির সময় মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। উনি একজন ভিন্ন ধাতের সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন (বর্তমানে অবসরে আছেন)। তখন আমাকে কেউ চিনত না, এমনকি সচিবালয়ে ঢুকতে তিন মাস সময় লেগে গিয়েছিল।
২০০৪ সালের ১৪ই অক্টোবর আমরা জমি রেজিস্ট্রেশান করি, তার দুই দিন পর ১৬ই অক্টোবর রেপটাইলস ফার্মের ground breaking হয়। সেটা ছিল মনে রাখার মত একটা দিন।
ঢাকা থেকে শীতল, জাহিদ, মফিজ, ডঃ রাশিদ আর আমি গিয়েছি। কাউকেই তেমন চিনিনা, জমি বিক্রেতার ছেলে লিটন ভাই আমাদের মাটি কাটার শ্রমিক জোগাড় করে দিবে। কাগজের মধ্যে একটা প্ল্যান আছে, কিন্তু কোন ধারনা নাই এই প্ল্যান কিভাবে বাস্তব রূপ পাবে। স্কুল জীবনের জ্যামিতি আর অনেকর উপর ভরসা করে দড়ি আর খুঁটি দিয়ে শুরু করলাম মাপজোখ, এক সময় দেখি আমাদের জমি ছেড়ে আরেকজনের জমিতে গিয়ে পরেছি।