নোট
পুর্ব্বরাগ
কবির নাম: জসীমউদ্দীন
দীঘিতে তখনো শাপলা ফুলেরা হাসছিলো আনমনে,
টের পায়নিক পান্ডুর চাঁদ ঝুমিছে গগন কোণে ।
উদয় তারার আকাশ-প্রদীপ দুলিছে পুবের পথে,
ভোরের সারথী এখনো আসেনি রক্ত-ঘোড়ার রথে।
গোরস্থানের কবর খুঁড়িয়া মৃতেরা বাহির হয়ে,
সাবধান পদে ঘুরিছে ফিরিছে ঘুমন্ত লোকালয়ে।
মৃত জননীরা ছেলে মেয়েদের ঘরের দুয়ার ধরি,
দেখিছে তাদের জোনাকি আলোয় ক্ষুধাতুর আঁখি ভরি।
মরা শিশু তার ঘু্মন্ত মার অধরেতে দিয়ে চুমো,
কাঁদিয়া কহিছে, “জনম দুখিনী মারে, তুই ঘুমো ঘুমো।”
ছোট ভাইটিরে কোলেতে তুলিয়া মৃত বোন কেঁদে হারা,
ধরার আঙনে সাজাবে না আর খেলাঘরটিরে তারা।
দুর মেঠো পথে প্রেতেরা চলেছে আলেয়ার আলো বলে,
বিলাপ করিছে শ্মশানের শব ডাকিনী যোগীনি লয়ে।
রহিয়া রহিয়া মড়ার খুলিতে বাতাস দিতেছে শীস,
সুরে সুরে তার শিহরি উঠিছে আঁধিয়ারা দশধিশ।
আকাশের নাটমঞ্চে নাচিছে অন্সরী তারাদল,
দুগ্ধ ধবল ছায়াপথ দিয়ে উড়াইয়ে অঞ্চল।
কাল পরী আর নিদ্রা পরীরা পালঙ্ক লয়ে শিরে,
উড়িয়া চলেছে স্বপনপুরীর মধুবালা-মন্দিরে।
হেনকালে দুর গ্রামপথ হতে উঠিল আজান-গান ।
তালে তালে তার দুলিয়া উঠিল স্তব্ধএ ধরাখান।
কঠিন কঠোর আজানের ধবনি উঠিল গগন জুড়ে।
সুরেরে কে যেন উঁচু হতে আরো উঁচুতে দিতেছে ছুঁড়ে।
পু্র্ব গগনে রক্ত বরণ দাঁড়াল পিশাচী এসে,
ধরণী ভরিয়া লহু উগারিয়া বিকট দশনে হেসে।
ডাক শুনি তার কবরে কবরে পালাল মৃতের দল,
শ্মাশানঘাটায় দৈত্য দানার থেমে গেল কোলাহল।
গগনের পথে সহসা নিবিল তারার প্রদীপ মালা
চাঁদ জ্বলে জ্বলে ছাই হয়ে গেল ভরি আকাশের থালা।
তখনো কঠোর আজান ধ্বনিছে, সাবধান সাবধান!
ভয়াল বিশাল প্রলয় বুঝিবা নিকটেতে আগুয়ান।
ওরে ঘুমন্ত-ওরে নিদ্রিত-ঘুমের বসন খোল,
ডাকাত আসিয়া ঘিরিয়াছে তোর বসত-বাড়ির টোল।
শয়ন-ঘরেতে বাসা বাঁধিয়াছে যত না সিঁধেল চোরে,
কন্ঠ হইতে গজমতি হার নিয়ে যাবে চুরি করে।
শয়ন হইতে জাগিল সোজন, মনে হইতেছে তার
কোন অপরাধ করিয়াছে যেন জানে না সে সমাচার।
চাহিয়া দেখিল, চালের বাতায় ফেটেছে বাঁশের বাঁশী,
ইঁদুর আসিয়া থলি কেটে তার ছড়ায়েছে কড়িরাশি।
বার বার করে বাঁশীরে বকিল, ইদুরের দিল গালি,
বাঁশী ও ইঁদুর বুঝিল না মানে সেই তা শুনিল খালি।
তাড়াতাড়ি উঠি বাঁশীটি লইয়া দুলীদের বাড়ি বলি,
চলিল সে একা রাঙা প্রভাতের আঁকা-বাঁকা পথ দলি।
খেজুরের গাছে পেকেছে খেজুর, ঘনবন-ছায়া-তলে,
বেথুল ঝুলিছে বার বার করে দেখিল সে কুতুহলে।
ও-ই আগডালে পাকিয়াছে আম, ইসরে রঙের ছিরি,
এক্কে ঢিলেতে এখনি সে তাহা আনিবারে পারে ছিঁড়ি।
দুলীরে ডাকিয়া দেখাবে এসব, তারপর দুইজনে,
পাড়িয়া পাড়িয়া ভাগ বসাইবে ভুল করে গণে গণে।
এমনি করিয়া এটা ওটা দেখি বহুখানে দেরি করি,
দুলীদের বাড়ি এসে-পৌঁছিল খুশীতে পরাণ ভরি।
দুলী শোন্ এসে- একিরে এখনো ঘুমিয়ে যে রয়েছিস্?
ও পাড়ার লালু খেজুর পাড়িয়া নিয়ে গেলে দেখে নিস্!
সিঁদুরিয়া গাছে পাকিয়াছে আম, শীগগীর চলে আয়,
আর কেউ এসে পেড়ে যে নেবে না, কি করে বা বলা যায়।
এ খবর শুনে হুড়মুড় করে দুলী আসছিল ধেয়ে,
মা বলিল, এই ভর সক্কালে কোথা যাস্ ধাড়ী মেয়ে?
সাতটা শকুনে খেয়ে না কুলোয় আধেক বয়সী মাগী,
পাড়ার ধাঙড় ছেলেদের সনে আছেন খেলায় লাগি।
পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেতে পাড়ায় যে টেকা ভার,
চুন নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!
এ সব গালির কি বুঝিবে দুলী, বলিল একটু হেসে,
কোথায় আমার বসয় হয়েছে, দেখই না কাছে এসে।
কালকে ত আমি সোজনের সাথে খেলাতে গেলাম বনে,
বয়স হয়েছে এ কথা ত তুমি বল নাই তক্ষণে।
এক রাতে বুঝি বয়স বাড়িল? মা তোমার আমি আর
মাথার উকুন বাছিয়া দিব না, বলে দিনু এইবার।
ইহা শুনি মার রাগের আগুন জ্বলিল যে গিঠে গিঠে,
গুড়ুম গুড়ুম তিন চার কিল মারিল দুলীর পিঠে।
ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে চাহিয়া সোজন দেখিল এ অবিচার,
কোন হাত নাই করিতে তাহার আজি এর প্রতিকার।
পায়ের উপরে পা ফেলিয়া পরে চলিল সমুখ পানে,
কোথায় চলেছে কোন পথ দিয়ে, এ খবর নাহি জানে।
দুই ধারে বন, লতায়-পাতায় পথেরে জড়াতে চায়,
গাছেরা উপরে ঝলর ধরেছে শাখা বাড়াইয়া বায়।
সম্মুখ দিয়া শুয়োর পালাল, ঘোড়েল ছুটিল দূরে,
শেয়ালের ছাও কাঁদন জুড়িল সারাটি বনানী জুড়ে।
একেলা সোজন কেবলি চলেছে কালো কুজঝটি পথ,
ভর-দুপুরেও নামে না সেথায় রবির চলার রথ।
সাপের ছেলম পায়ে জড়ায়েছে, মাকড়ের জাল শিরে,
রক্ত ঝরিছে বেতসের শীষে শরীরের চাম ছিঁড়ে।
কোন দিকে তার ভ্রুক্ষেপ নাই রায়ের দীঘির পাড়ে,
দাঁড়াল আসিয়া ঘন বেতঘেরা একটি ঝোপের ধারে।
এই রায়-দীঘি, ধাপ-দামে এর ঘিরিয়াছে কালো জল,
কলমি লতায় বাঁধিয়া রেখেছে কল-ঢেউ চঞ্চল।
চারধারে এর কর্দম মথি বুনো শুকরের রাশি,
শালুকের লোভে পদ্মের বন লুন্ঠন করে আসি।
জল খেতে এসে গোখুরা সপেরা চিহ্ন এঁকেছে তীরে,
কোথাও গাছের শাখায় তাদের ছেলম রয়েছে ছিঁড়ে।
রাত্রে হেথায় আগুন জ্বালায় নর-পিশাচের দল,
মড়ার মাথায় শিস দিয়ে দিয়ে করে বন চঞ্চল।
রায়েদের বউ গলবন্ধনে মরেছিল যার শাখে,
সেই নিমগাছ ঝুলিয়া পড়িয়া আজো যেন কারে ডাকে!
এইখানে এসে মিছে ঢিল ছুঁড়ে নাড়িল দীঘির জল,
গাছেরে ধরিয়া ঝাঁকিল খানিক, ছিঁড়িল পদ্মদল।
তারপর শেষে বসিল আসিয়া নিমগাছটির ধারে,
বসে বসে কি যে ভাবিতে লাগিল, সেই তা বলিতে পারে।
পিছন হইতে হঠাৎ আসিয়া কে তাহার চোখ ধরি,
চুড়ি বাজাইয়া কহিল, কে আমি বল দেখি ঠিক করি?
ও পাড়ার সেই হারানের পোলা। ইস শোন বলি তবে
নবীনের বোন বাতাসী কিম্বা উল্লাসী তুমি হবেই হবে!
পোড়ামুখীরা এমনি মরুক- আহা, আহা বড় লাগে,
কোথাকার এই ব্রক্ষদৈত্য কপালে চিমটি দাগে।
হয়েছে হয়েছে, বিপিনের খুড়ো মরিল যে গত মাসে,
সেই আসিয়াছে, দোহাই! দোহাই! বাঁচি না যে খুড়ো ত্রাসে!
‘‘ভারি ত সাহস!’’ এই বলে দুলী খিল্ খিল্ করে হাসি,
হাত খুলে নিয়ে সোজনের কাছে ঘেঁষিয়া বসিল আসি।
একি তুই দুলী! বুঝিবা সোজন পড়িল আকাশ হতে,
চাপা হাসি তার ঠোঁটের বাঁধন মানে না যে কোনমতে।
দুলী কহে, দেখ! তুই ত আসিলি, মা তখন মোরে কয়,
বয়স বুঝিয়া লোকের সঙ্গে আলাপ করিতে হয়।
ও পাড়ার খেঁদি পাড়ারমুখীরে ঝেঁটিয়ে করিতে হয়।
আর জগাপিসী, মায়ের নিকটে যা তা বলিয়াছে তারা।
বয়স হয়েছে আমাদের থেকে ওরাই জানিল আগে,
ইচ্ছে যে করে উহাদের মুখে হাতা পুড়াইয়া দাগে।
আচ্ছা সোজন! সত্যি করেই বয়স যদিবা হত,
আর কেউ তাহা জানিতে পারিত এই আমাদের মত?
ঘাড় ঘুরাইয়া কহিল সোজন, আমি ত ভেবে না পাই,
আজকে হঠাৎ বয়স আসিল? আসিলই যদি শেষে,
কথা কহিল না, অবাক কান্ড, দেখি নাই কোনো দেশে।
দুলালী কহিল, আচ্ছা সোজন, বল দেখি তুই মোরে,
বয়স কেমন! কোথায় সে থাকে! আসে বা কেমন করে!
তাও না জানিস! সোজন কহিল, পাকা চুল ফুরফুরে,
লাঠি ভর দিয়ে চলে পথে পথে বুড়ো সে যে থুরথুরে।
দেখ দেখি ভাই, মিছে বলিসনে, আমার মাথার চুলে,
সেই বুড়ো আজ পাকাচুল লয়ে আসে নাইতরে ভুলে?
দুলীর মাথার বেণীটি খুলিয়া সবগুলো চুল ঝেড়ে,
অনেক করিয়া খুঁজিল সোজন, বুড়োনি সেথায় ফেরে!
দুলীর মুখ ত সাদা হয়ে গেছে, যদি বা সোজন বলে,
বয়স আজিকে এসেছে তাহার মাথার কেশেতে চলে!
বহুখন খুঁজি কহিল সোজন-নারে না, কোথাও নাই,
তোর চুলে সেই বয়স-বুড়োর চিহ্ন না খুঁজে পাই!
দুলালী কহিল, এক্ষুণি আমি জেনে আসি মার কাছে,
আমার চুলেতে বয়সের দাগ কোথা আজি লাগিয়াছে।
দুলী যেন চলে যায়ই আর কি, সোজন কহিল তারে,
এক্ষুণি যাবি? আয় না একটু খেলিগে বনের ধারে।
বউ-কথা কও গাছের উপরে ডাকছিল বৌ-পাখি,
সোজন তাহারে রাগাইয়া দিল তার মত ডাকি ডাকি।
দুলীর তেমনি ডাকিতে বাসনা, মুখে না বাহির হয়,
সোজনেরে বলে, শেখা না কি করে বউ কথা কও কয়?
দুলীর দুখানা ঠোঁটেরে বাঁকায়ে খুব গোল করে ধরে,
বলে, এইবার শিস দে ত দেখি পাখির মতন স্বরে।
দুলীর যতই ভুল হয়ে যায় সোজন ততই রাগে,
হাসিয়া তখনদুলীর দুঠোট ভেঙে যায় হেন লাগে।
ধ্যেৎ বোকা মেয়ে, এই পারলি নে, জীভটা এমনি করে,
ঠোটের নীচেতে বাঁকালেই তুই ডাকিবি পাখির স্বরে।
এক একবার দুলালী যখন পাখির মতই ডাকে,
সোজনের সেকি খুশী, মোরা কেউ হেন দেখি নাই তাকে।
দেখ, তুই যদি আর একটুকু ডাকিতে পারিস ভালো,
কাল তোর ভাগে যত পাকা জাম হবে সব চেয়ে কালো।
বাঁশের পাতার সাতখানা নথ গড়াইয়া দেব তোরে,
লাল কুঁচ দেব খুব বড় মালা গাঁথিস যতন করে!
দুলী কয়, তোর মুখ ভরা গান, দে না মোর মুখে ভরে,
এই আমি ঠোঁট খুলে ধরিলাম দম যে বন্ধ করে।
দাঁড়া তবে তুই, বলিয়া সোজন মুখ বাড়ায়েছে যবে,
দুলীর মাতা যে সামনে আসিয়া দাঁড়াইল কলরবে।
ওরে ধাড়ী মেয়ে, সাপে বাঘে কেন খায় না ধরিয়া তোরে?
এতকাল আমি ডাইনি পুষেছি আপন জঠরে ধরে!
দাঁড়াও সোজন! আজকেই আমি তোমার বাপেরে ডাকি,
শুধাইব, এই বেহায়া ছেলের শাসি- সে দেবে নাকি?
এই কথা বলে দুলালীরে সে যে কিল থাপ্পড় মারি,
টানিতে টানিতে বুনো পথ বেয়ে ছুটিল আপন বাড়ি।
একলা সোজন বসিয়া রহিল পাথরের মত হায়,
ভাবিবারও আজ মনের মতন ভাষা সে খুঁজে না পায়?