ভূমি জরিপ বা ল্যান্ড সার্ভে একটি টেকনিক্যাল কার্যক্রম। এর সাহায্যে একটি এলাকার বা নির্দিষ্ট ভূমিখন্ডের একটি নির্দিষ্ট স্কেলে নির্দিষ্ট মানের কাগজে পরিমাপ গ্রহণক্রমে এর অবস্থান, আয়তন ও সীমানা নির্ণয় করা হয়। এরূপ কার্যক্রম এর মাধ্যমে একটি মৌজার নকশা তেরি হয় এবং পরবর্তীতে এর উপর ভিত্তি করে ভূমি খন্ডের দখল ও মালিকানার বর্ণনা নিয়ে একটি খতিয়ান প্রণীত হয়। এ দু’টো মিলে রেকর্ড অব রাইট বা স্বত্বলিপি প্রস্তুত হয়। ভূমি জরিপ সুষ্টভাবে সম্পন্ন করা না গেলে সরকারের জমি যেমন অবৈধ দখল হয়ে যেতে পারে, তেমনি ব্যক্তিগত জমির ক্ষেত্রে জমির মালিকানা সমস্যা হতে পারে। যা জাতীয় ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা হিসেবে ভয়ংকর আকার ধারণ করতে পারে।
ভূমি জরিপের উদ্দেশ্যঃ
জরিপ কার্যক্রম সাধারণত জেলাভিত্তিক পরিচালনা করা হয়। জেলার বা সুনির্দিষ্ট কোন এলাকা বা মৌজার প্রত্যেক ভূখন্ড সরেজমিনে পরিমাপ করে নির্দিষ্ট স্কেল অনুসারে এর অবস্থান এাবং আয়তন সম্বলিত একটি মৌজা নকশা প্রণয়ন করে প্রত্যেক ভূখন্ডের মালিক, দখলদার, জমির পরিমাণ, খাজনার পরিমাণ, জমির শ্রেণী এবং চৌহদ্দি নির্দেশক রেকর্ড বা খতিয়ান প্রণয়ন করাই জরিপ কার্যক্রমের উদ্দেশ্য। নতুন মৌজা নকশা প্রণয়ন এবং জমির মালিকানা জমির বিবরন সম্বলিত খতিয়ান প্রণয়ন করা জরিপের অন্যতম কাজ।
ভূমি জরিপ কার্যক্রমঃ
পাঠান সম্রাট শেরশাহ সর্বপ্রথম এ উপমহাদেশে জরিপ প্রথা চালু করেন। পরবর্তীতে মোঘল সম্রাট আকবরের একজন অন্যতম সভাসদ টোডরমল সার্ভে ও সেটেলমেন্ট কার্যক্রম পরিচালনা করেন। কিন্তু উক্ত কার্যক্রম সম্পূর্ণ এবং Plot-to-Plot সার্ভে কার্যক্রম ছিল না বরং একটি সংক্ষিপ্ত কার্যক্রম ছিল। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বেশ গুরুত্বপূর্ণ জরিপ পরিচালনা করা হয়। যা বিস্তারিত নিচে আলোচনা করা হল-
- সিএস বা CS(Cadastral Survey): এদেশে সর্বপ্রথম জরিপের কাজ শুরু হয় ১৮৮৭ সালে Cadastral Survey বা সিএস এবং শেষ হয় ১৯৪০ সালে। এ জরিপই এখনো দেশের Record of Rights (ROR)। সিএস জরিপের মাধ্যমে প্রতিটি মৌজার জন্য নকশা (ম্যাপ) প্রস্তুত করে প্রতিটি ভূমি খন্ডের বাস্তব অবস্থা, আয়তন, শ্রেণী, জমির পরিমাণ, খাজনার পরিমাণ ইত্যাদি উল্লেখ করে খতিয়ান প্রণয়ন করা হয়। সিএস খতিয়ান ও নকশা খুবই নিখুঁত ও নির্ভরযোগ্য ছিল। এ জরিপকে ডিএস বা ডিস্ট্রিক্ট সেটেলমেন্ট জরিপ বলা হয় এবং খতিয়ানকে সিএস খতিয়ান বলা হয়।
- এসএ বা SA(State Acquisition Operation): জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের প্রেক্ষাপটে ১৯৫৫ সালে State Acquisition Operation বা এসএ এর আওতায় রেকর্ড প্রণয়নের কাজ শুরু হয় এবং ১৯৬২ সালে এ কাজ শেষ হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে এসএ রেকর্ড প্রস্তুতকালে সরেজমিন ভিত্তিক কোন জরিপ কাজ পরিচালিত হয় নি। জমিদারের আওতাধীন প্রজা/ মালিকদের নামে মালিকানা স্বত্ত এবং খাস জমির তালিকা প্রস্তুত করাই ছিল এ জরিপের উদ্দেশ্য। টেস্ট একুইজেশন এন্ড টেনেন্সি আইন প্রণয়ন করে ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করা হয়। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পর যে খতিয়ান তৈরি করা হয় তাকে বলে এসএ খতিয়ান। ১৯৫৬ সালের জরিপে এ খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়।
- আরএস বা RS(Revisional Settlement): সিএস জরিপ সমাপ্ত হতে ৫০ বছর সময় লাগে। এ সময়ের মধ্যে জমির প্রকৃতি ও মালিকানা পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে ১৯৪০ সনে বৃহত্তর ফরিদপুর ও বরিশাল জেলায় আরএস বা সংশোধনী জরিপ শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া ও পাবনা জেলায় আরএস জরিপ সম্পন্ন করা হয়। এসএ খতিয়ানের পর ঐ আইনের ১৪৪ ধারা অনুসারে এ খতিয়ান প্রকাশিত হয়।
- জোনাল জরিপ: ভূমি সংস্কার কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক রিভিশনাল সেটেলমেন্ট পদ্ধতির পরিবর্তে ১৯৮৫-৮৬ অর্থ বছরে স্থায়ী পদ্ধতির জোনাল সেটেলমেন্ট আরম্ভ হয়। ১০ টি বৃহত্তর জেলায় জরিপ কাজ হয় এবং এ জরিপে সৃষ্ট খতিয়ানকে বাংলাদেল সার্ভে বা বি. এস. খতিয়ান বলে। কেউ আবার একে আর. এস. খতিয়ান বলে।
- দিয়ারা জরিপ: দরিয়া শব্দ থেকে দিয়ারা শব্দের উদ্ভব। যে সকল এলাকায় নদী বা সাগরের কারনে জমির ভাঙ্গাগড়া বেশী হয় সে অঞ্চলে দিয়ারা জরিপ পরিচালিত হয়।
ভূমি জরিপ পদ্ধতি সমূহ
ভূমি জরিপকালে যে সকল পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তা হলঃ
- শিকল জরিপ
- কম্পাস জরিপ
- প্লেনটেবিল জরিপ
- থিয়োডোলাইট জরিপ
শিকল জরিপ
ভূমি জরিপের জন্য শিকল জরিপ সবচেয়ে সহজ। য়ে জায়গায় পরিমাপ করতে হবে তা কতকগুলো ত্রিভুজে ভাগ করে নিতে হয় এবং ত্রিভুজের বাহুগুলোর দৈর্ঘ্য শিকল দিয়ে মাপ করা হয়। জ্যামিতিক ক্ষেত্রগুলির মধ্যে ত্রিভুজ অংক পদ্ধতি সর্র্বাপেক্ষা সহজ। পুরো জায়গাটিকে সারি সারি ত্রিভুজে ভাগ করে নিতে হয়। ত্রিভুজের কোণগুলি ৬০ ডিগ্রির করে বা ১২০ ডিগ্রির বেশী না হয় তা দেখতে হবে। মাঠের মাঝামাঝি দিয়ে একটি বা দুটি মেরুদন্ড রেখা টেনে নেয়া যায়। এই মেরুদন্ড রেখার সাথে প্রধান প্রধান ত্রিভুজগুলো আবদ্ধ থাকবে এবং এরপর বড় বড় ত্রিভুজগুলোকে আরো ছোট ছোট ত্রিভুজে বিভক্ত করতে হবে। এভাবে ই শিকল জরিপ সম্পন্ন করা হয়।
কম্পাস জরিপ
কম্পাসের সাহায্যে যে জরিপ পরিচালিত হয় তার নাম কম্পাস জরিপ। এতে দুই ধরনের কম্পাস ব্যাবহার করা হয়। এ কম্পাস দুটি হল প্রিজমেটিক কম্পাস এবং সার্ভেয়াস কম্পাস। বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন, রাস্তা, নদী এবং ধারাবাহিক রেখার নকশা প্রণয়ন কাজে প্রিজমেটিক কম্পাস ব্যাবহার করা হয়। আর বড় নদী বা সমুদ্র এলাকায় যখন বিশাল চর জেগে উঠে তখন তা নরম থাকে যে তার উপর দিয়ে চলাফের করা যায় না । তখন কম্পাস জরিপের মাধ্যমে তার অবস্থান, সীমানা এবং আয়তন নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। তবে এ জরিপের বর্তমানে কোন ব্যাবহার নেই বললেই চলে।
প্লেনটেবিল জরিপ
ভূমি জরিপে নকশা প্রস্ততের জন্য বিশেষ ধরনের তিন পা বিশিষ্ট একটি অংশ এবং ৩’ হতে ২’-৬” পরিমাপের মধ্যস্থলে চাকতিযুক্ত টেবিল যা প্রয়োজনে ত্রিপায়ার সাথে নাট দ্বারা আটকানো যায় এ ধরনের টেবিলকে ত্রি-পায়া টেবিল বলা হয়। ত্রি- পায়া হওয়ার কারণে সমতল কিংবা উঁচু নিচু স্থানেও এটি সেট করা যায়। এটির উপর প্রাপ্ত পি -৭০ শিট সেট করে নকশা অংকন করা হয়।
থিয়োডোলাইট জরিপ
একটি ভূমির নকশা প্রস্তুতির জন্য সরজমিনে কিছু নির্দিষ্ট পয়েন্টে চিহ্নিত করে (ট্রাভার্স পয়েন্ট) ঐ সকল পয়েন্টের স্থানাংক নির্ণয়ের জন্য এক পয়েন্ট হতে অপর পয়েন্টের কৌণিক দূরত্ব পরিমাপ, পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি কাজের জন্য দূরবীণযুক্ত যে যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয় তাকে থিওডোলাইট যন্ত্র বলে। এর সাহায্যে প্রাপ্ত ট্টাভার্স পয়েন্টের স্থানাংক দ্বারা তৈরি নির্দিষ্ট স্কেলের পি-৭০ শিট (যার উপর নকশা আকা হয়) প্রস্তুত করা হয়। জরিপ কাজে এ যন্ত্রের কোন বিকল্প নেই।
ভূমি জরিপের যন্ত্রপাতি এবং তার ব্যাবহার
গান্টার শিকল
ভূমির পরিমাপ পদ্ধতি সঠিক এবং সহজ করার জন্য ফরাসী বিজ্ঞানী এডমন্ড গান্টা এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তিনি ভূমি পরিমাপের জন্যে ইস্পাত দ্বারা এক ধরণের শিকল তৈরি করেন। পরবর্তীতে তার নাম অনুসারেই এই শিকলের নামকরণ করা হয় গান্টার শিকল। আমাদের দেশে গান্টার শিকল দ্বারা জমি জরিপ অত্যন্ত জনপ্রিয়। একর, শতক এবং মাইলষ্টোন বসানোর জন্য গান্টার শিকল অত্যন্ত উপযোগী। এই শিকলের দৈর্ঘ্য ২০.৩১ মিটার (প্রায়) বা ৬৬ ফুট। গান্টার শিকল ভূমি পরিমাপের সুবিধার্থে একে ১০০ ভাগে ভাগ করা হয় থাকে। এর প্রতিটি ভাগকে লিঙ্ক বা জরীপ বা কড়ি বিভিন্ন নামে ডাকা হয়।
প্রতি এক লিঙ্ক = ৭.৯২ ইঞ্চি
দৈর্ঘ্য ১০ চেইন × প্রস্থে ১ চেইন = ১০ বর্গ চেইন = ১ একর
গান্টার শিকলে প্রতি ১০ লিঙ্ক বা ৭৯.২ ইঞ্চি পর পর নস বা ফুলি স্থাপন করা হয় (নস ফুলি)। যেমনঃ
- ১০ লিঙ্ক বা ৭৯.২ ইঞ্চি পর স্থাপিত হয়
- ২০ লিঙ্ক বা ১৫৮.৪ ইঞ্চি পর স্থাপিত হয়
- ৩০ লিঙ্ক বা ২৩৭.৩ ইঞ্চি পর স্থাপিত হয়
- ৪০ লিঙ্ক বা ৩১৬.৮ ইঞ্চি পর স্থাপিত হয়
- ৫০ লিঙ্ক বা ৩৯৬.০ ইঞ্চি পর স্থাপিত হয়
কিন্তু ৮০ গান্টার বা ১৭৬০ গজ পর স্থাপিত হয় মাইল ষ্টোন।
১০ শিকল = ১ ফালং
একর শতকে ভূমির পরিমাপ
- ১০০ লিঙ্ক = ১ গান্টার শিকল
- ১০০০ বর্গ লিঙ্ক = ১ শতক
- ১,০০,০০০ বর্গ লিঙ্ক = ১ একর
ভূমি বা জমির আয়তন এর উপর চেইন বা ফিতা ব্যবহার নির্ভর করে। সাধারণ ব্যক্তিমালিকানার জমি আয়তনে ছোট হয় বিধায়, ফিতা ব্যবহার করা সুবিধাজনক। তবে আয়তনে অনেক বড় হলে অথবা সরকারি জরিপের সময় শিকল ব্যবহার সুবিধাজনক। অর্থাৎ ভূমির পরিমান বেশি হলে চেইন এবং কম হলে ফিতা ব্যবহার করা হয়।
ডায়াগনাল স্কেল
ইহা একটি চার কোনা বিশিষ্ট তামা ব্রোঞ্জের তৈরি স্কেল। ইহার চার পাশে ১০ টি ঘর বা কক্ষ থাকে প্রতিটি ঘরের মান ১০০ লিংক। ১৬”=১ মাইল স্কেলে ইহা তৈরি করা হয়। এবং গান্টার চেইনের সাথে মিল আছে বলে একে গান্টার স্কেলও বলা হয়।
আভার অফসেট
এটি একটি প্লাষ্টিকের তৈরি স্কেল এই স্কেলের সাথে গান্টার স্কেলের মিল আছে। ইহার দৈর্ঘ্য ২ ” এবং প্রস্ত .৫” (ইঞ্চি) এই স্কেলের সাহায্যে নকশার সংকোচিত দুরত্ব সহজে মাপা যায়। এটা ছাড়া অফনেট নেয়ার ক্ষেত্রে ইহা বিশেষ সুবিধাজনক। গুনে গুনে সংখ্যা হিসাব করা যায় বলে একে গুনিয়া বলা হয়।
ডিভাইডার বা কাটা কম্পাস
ইহা একটি জ্যামিতিক কম্পাস। ইহার সাহায্যে নকশার সংকোচিত দুরত্ব নিয়ে ডাইগোনাল স্কেলে মাপ নেয়া যায় এবং দুরত্ব গুনিয়া গুনিয়া সংখ্যা বুঝা যায়।